উদ্বোধন । অভিজিৎ সরকার

 


উদ্বোধন  

অভিজিৎ সরকার

 

নমস্কার।  শুরু করছি আজকের যুক্তিযুদ্ধ লাইভ সেশন । আপনাদের সাথে আমি অর্ক, সদাই সতর্ক। আর প্যানেলে আজ যথারীতি বিরোধী আর শাসক দুপক্ষেরই প্রতিনিধিরা প্রস্তুত। একদম দেরী না করে চলুন প্রথমে চলে যাই আমাদের লাইভ রিপোর্ট টীমের কাছে। ধীরভূমের একদম আনাচে এই গ্রাম ব্যোমটিলা। সেই ছবি দেখাচ্ছি আপনাদের। ক্যামেরা টীম নিয়ে যেখানে পৌঁছে গেছে আমাদের রিপোর্টার সংবেদন শীল। 

সংবেদন? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা। 

 হ্যাঁ, পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে অর্কদা। কোন সন্দেহ নেই, এই এলাকায় রাস্তাঘাটের তুলনায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অনেক বেশী তুখোড়।

 খুব জরুরী তথ্য দিলে সংবেদন। যে কারণে এখন একটা বিজ্ঞাপন বিরতি নেয়াও জরুরী। দর্শক বন্ধু সঙ্গে থাকুন। ছোট্ট বিরতির পরে আমরা ফিরে আসছি আজকের মস্ত বড় স্টোরি নিয়ে। আপনার প্রিয় অনুষ্ঠান যুক্তিযুদ্ধে! 

দর্শকরা হাতি ঘোড়া, ব্যাং মাথা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন হয়ে যায় বিজ্ঞাপন। জমকালো গান। 

 

আহা নেটওয়ার্ক আমাদের সবখানে সেট আছে বস। 

কোত্থাও ড্রপ নেই, নেই সিগন্যালে কোন লস। 

আমলকি নেটওয়ার্ক - কিছুতেই ফোনের পেছন ছাড়ে না!   

 

বিজ্ঞাপন শেষ হতে কিঞ্চিত যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে। স্টুডিতে ফেরার বদলে ব্যোমটিলার সবুজ মাঠ। গামছা পরিহিত কোমর থেকে হাঁটু অবধি এক ব্যক্তির পশ্চাদ্দেশ গোটা স্ক্রীন ভরিয়ে রেখেছে। একে বেঁকে তারই  পেছন পেছন ছুটছে যেন ক্যামেরা। সংবেদন-এর হাওয়ায় ঘষা খাওয়া কষা কন্ঠ শুনে ফেলে দর্শক ক্ষণিকের জন্য। 

 —ও দাদু কথায় চললে? দাঁড়াও দাঁড়াও! ওরে মশাই, যেখানে যাচ্ছো দু মিনিট পরে যেও। 

এখানে দাঁড়ালে তোমাকে টিভিতে পরিষ্কার দেখাতে পারবো…ওখানে চলে গেলে সেন্সরের প্যাঁচ। ছবি তখন কিন্তু ঝাপসা!   

 

গোঁ গোঁ…ক্যারখ্যার…ফ্রচাং 

যান্ত্রিক ক্রুটি সামলে আচমকা দৃশ্য আর শব্দ বদলে যায়। স্টুডিওর ভেতরে বিরোধীপক্ষের পর্বতপ্রমাণ প্রতিনিধি গর্জে উঠে বলেন, দেখলেন? একদম স্বচ্ছ ছবি! গাড়ু হাতে সবেগে মাঠে ছুটছে! আহা কি নির্মল দৃশ্য! সাবাস! সাবাস!  

শাসক দলের প্রতিনিধি সঙ্গে সঙ্গে হায়নার মতো খেঁকিয়ে উঠলেন, ন্যাকা! আপনি কি গাড়ু বিশেষজ্ঞ? জীবনে গ্রামে গেছেন? গেলে জানতেন ওটা ঘটি। জল খেতে ব্যবহার হয়! 

- রাখুন! জল খেতে যেন ক্ষেতে যায়! … আসল সত্য হলো আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। ভারত সরকার ঘরে ঘরে শৌচালয় পৌঁছে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার অপমান হয়েছে। এই ব্যোমটিলা গ্রাম স্বজন পোষণ আর পক্ষপাতে দুষ্ট।        

সঞ্চালক মধ্যস্থা করার উদ্দেশ্যে বলে, ভুবনগিরি বাবু … কমললোচনবাবু এখনই এতো হাঁপিয়ে উঠবেন না আপনারা। যুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হলো। পক্ষপাত আসলে কোন পক্ষের দিকে আমরা সরাসরি ব্যোমটিলা থেকেই শুনে নেবো। সংবেদন? ওভার টু ইউ! 

মাঠের ধারে মুরগি ছানার মতো ঝাঁকিয়ে ওঠে সংবেদন। তার সামনে ঝাঁকড়া গাছের গোড়ায় ইটের চাতালে এক লোলচর্ম বৃদ্ধকে বসিয়ে রেখেছে সে। এবার পেছনে খানিক দূরে একটা ছাউনি আর বেড়ায় ঘেরা উঁচু মাচার দিকে আঙ্গুল তুলে নির্দেশ করে… 

“দেখুন দর্শক বন্ধু, কি জিনিষ দেখা যাচ্ছে পেছনে! মান্ধাতা যুগের একদম খাঁটি একখানা খাটা পায়খানা আমরা খুঁজে পেয়েছি এইখানে। যেটা ভগ্ন দশায় নেই, এখনো রীতিমত সক্রিয়। এই যে দেখুন, আমার সঙ্গে এই মুহূর্তে রয়েছে এই প্রাচীন নিদর্শনটির মূল মালিক শ্রী ফাটু উস্তি। ফাটুবাবু, বলুন আপনার পায়খানা সম্বন্ধে দর্শকদের বলুন… 

ফাটু উস্তি ভুরু কুঁচকে ক্যামেরার দিকে তাকায়। তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিয়ে বলে, 

- ঠিক কি জানতে চাইছেন আপনারা শহরের বাবুরা সিটাই যে ঠাওর করতে পারছি নে এখনো…

- না, মানে…ধরুন… এটা কবেকার জিনিষ? এখন কেমন সার্ভিস দিচ্ছে? 

- জিনিষ…সে তো  সে অনেক কাল আগেকার। সেই য’বে থিকে দেশ গাঁয়ে ভোট চালু হল গো… 

- মানে সাধারণ নির্বাচন? 

- অতশত জানিনে বাপু। তবে মুখ্যরমন্তিরি এয়েছিলেন সেবার এ গ্রামে…           

কানের পেছন থেকে একটি পুরুষ্টু বিড়ি বের করে ফাটু উস্তি। তারপর সেই বিড়িটি খাটা পায়খানার পানে তাক করে দেখিয়ে আলতো স্বরে বক্তব্য শেষ করে---ওইখানে তার পদধূলিও পড়েছিল...   

- ক্ক কি? কি বললেন? ওইখানে মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন? 

- হ্যাঁ গো খোকা। আমাদের এই পায়খানা সেদিন সবে সবে তৈরি শেষ করেছিল মিস্তিরা। তক্ষনকার  সময়ে এটাই ছিল গেরামের একমাত্তর। আর পার্টির মিটিং ছিল ঠা ঠা রোদ্দুরে চুনিদিঘির মাঠে...। তা ওই গরমে খুব উশখুশ দশা সেই বড় মানুষের। কিন্তু গাঁয়ের মানুষের মতো উনি কি করে আর মাঠে ঘাটে যাবেন? তাই ... তখন ... 

- আপনাদেরটা উদ্বোধন করে দিয়ে গেলেন?     

- তা যা বলিছেন...শুভ উদ্বোধন! কতক বছর তারপর খুব হৈ-রৈ চলেছে এই নিয়ে! অন্য বাড়িতে পায়খানা গড়বার পরেও কিন্তুক এই-টার একটা আলাদা মর্যাদা ছেল। ধরেন বিয়ে হলো গেরামে। নতুন জামাইরে নিয়ে বাসী বিয়ের সকালে লোকে এখানেই চলে আসতো...। এমন আরও কত কাহিনী আছে! ভেতরে বসে যখন বিড়িটা ধরাই ... সেই সব পুরানো ছবিই আজকাল ভেসে আসে চোখে! 

 

স্টুডিও ফেরত নিয়ে আসা হয় দর্শকদের। শাসক দলের প্রতিনিধি ভুবনগিরি বাবু হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, 

- ধ্যাত! কোত্থেকে জোগাড় করলেন এই মিথ্যবাদী বুড়োকে? টোট্যাল রাবিশ আর গাঁজাখুরি!   

সদা সতর্ক অর্ক তৎপর হয়ে এক গোছা কাগজ হাতে তুলে ধরে দেখায়। বলে, তথ্য কিন্তু উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। নির্বাচনে জয়ের পরে সে বছরে বাস্তবিকই মুখ্যমন্ত্রীর মিটিং হয়েছিল ওই এলাকায়! 

বেশ মানলাম, মিটিং হয়েছিল! - বিরোধী দলের কমললোচন বাবু এবারে গাঁক গাঁক করে উঠলেন। 

এটাও না হয় মানলাম যে… ইয়ে ওই শৌচাগারটি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী...

কথা শেষ হয় না কমললোচন বাবুর। কারণ ভুবনগিরি একটা পেল্লায় চাঁটি মেরেছেন টেবিলে। এবং তার গাঁক গাঁক-টি আরও উচ্চগ্রামের। 

না, না...প্রমাণ ছাড়া আর একটি কথাও বলবেন না আপনি! আপনাদের আই  টি সেল গুজব ছড়াতে ওস্তাদ, সে কথা সবাই জানে। কিন্তু তিলকে তাল করবার সেই কারবার এখানে আমি চলতে দেবো না! আবারও বলছি, ওই উটকো বুড়ো লোকটার কথার কোনও ভ্যালু নেই!        

- কি আশ্চর্য? খামোখা মিথ্যে বলতে যাবে কেন?

- খামোখা নয়। কারণ আপনারা শিখিয়ে পড়িয়ে ওকে দিয়ে বলাচ্ছেন। ক'টা টাকাই বা নেবে এটুকু বলতে? 

- সেটা করে কি লাভ আমাদের? বোঝান দেখি!

- আরে! আপনাদের কেন্দ্রীয় নেতা এ রাজ্যে মিটিং করতে এসে ঘন ঘন গ্রামবাসীর বাড়িতে ইটিং করছে মিডিয়ার নজর কাড়তে! এবার হয়তো তার চেয়ে এক কদম বেশি কিছুর মতলব পাকাচ্ছে।

- অ্যাঁ! কি বললেন? 

- বোঝেন নি? ইনপুট আর আউটপুট দু দিক থেকেই আপনারা জনতার নজর কাড়তে চান! এই যে ঝামেলা করছেন, এটা তারই  গ্রাউন্ড তৈরি করার মতলবে!   

- কি হচ্ছে এসব অর্ক? ইন্সাল্ট করছে! অপবাদ দিচ্ছে! চোরের মায়ের বড় গলা! 

- অ্যাই! কাকে চোর বলছেন? কোন সাহসে? 

- চোরকে চোর বললে ধার্মিকের গায়ে ছ্যাঁকার কিছু কারণ আছে? আমি সেই চোরদের চোর বলছি যারা  শৌচালয় তৈরির কেন্দ্রীয় অনুদান চুরি করে ব্যোমটিলার এই দশা করে ছেড়েছে!        

বাক বিতণ্ডায় খানিকক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি চুড়ান্ত উত্তপ্ত। গভীর রাতে পথ কুকুরদের এলাকা লঙ্ঘন ঘটিত জটিল বিবাদে যেমন করাত চলার মতো অবিরাম শব্দ যুদ্ধ চলে, কতকটা সেরকম একটা ব্যাপার শুরু হয়ে গেল স্টুডিওতে দুই প্রতিনিধির মধ্যে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে সেই দূরবস্থার উন্নতি ঘটাতে অর্ক মাঝে মধ্যে সাবধানী দু একটা বাণী বলে উঠছিল বটে। কিন্তু তার ঝাঁজ বেশ নিস্তেজ প্রকারের। কারণ কানে টক ব্যাক হেডফোনে প্রোগ্রামের হেড প্রোডিউসার ক্রমাগত ফিসফিস করে বলছে- চলতে দাও! আরেকটু চলতে দাও! প্রতি মিনিটে বিপুল সংখ্যায় নতুন দর্শক ঢুকছে অনুষ্ঠানে! এবারের অ্যাড ব্রেকটায় আমরা অনায়াসে ডবল দামে বিজ্ঞাপনের স্পট বিক্কিরি করতে পারবো!        

এসব কিছু থেকে অনেক দূরে তখন ব্যোমটিলায় ফাটু উস্তি সানাইয়ের মতো সুর তুলে এক প্রস্থ বাতকর্ম সম্পন্ন করলো। তারপর সংবেদন শীলের উদ্দেশ্যে বলল, এ হলো বৃষ্টি নামা মেঘের শব্দ, বুঝলেন। আমারে আর দাঁড়াতি বললে চলবে না! কেলেঙ্কারি হই যাবে। 

- কিন্তু ফাটুবাবু...স্টুডিও থেকে হুট করে লিঙ্ক দিয়ে দিলে তখন আমার কি হবে! ও ফাটুবাবু! আমি যে বড় বিপদে পড়ে যাবো! আমারও যে পেট গুড়গুড় শুরু হচ্ছে!          

কে শোনে কার কথা! ফাটু বাবু সবেগে ধেয়ে গেল খাটা পায়খানার পানে। মচমচ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে পলকের মধ্যে উঠে গেল একদম টঙে, মূল কার্যক্রম যেখানে সমাধা হয়। সংবেদনের কানে ভেসে এলো  

 টিনের দরজা বন্ধ হওয়ার "ধমাস" শব্দ! আর আশ্চর্য কাণ্ড...ঠিক যেন সেই শব্দের সংকেত শুনেই,  পাশের কচুবন থেকে পড়ি কি মরি করে পেল্লায় দুটো শুয়োর বেরিয়ে এলো। 

সংবেদন হ্যাম খেয়েছে, পর্ক চপ খেয়েছে। কিন্তু এত কাছ থেকে ওই সব সুখাদ্যের মূল কাঁচা মাল-এর কাদা মাখা ভীষণ দর্শন রূপ আগে কখনোই দেখেনি। প্রায় গা ঘেঁষে জন্তু দুটো যখন খাটা পায়খানার পানে সোজা ছুট দিলো, সংবেদন আর তার ক্যামেরাম্যান, দুজনেই অপ্রস্তুত লম্ফ দিয়ে ছিটকে গেল দুদিকে। আর দুজনেরই পতন ঘটলো শুয়োরের পদদলিত কাদা জলে। যে অবস্থায় লাইভ অনুষ্ঠানে তারা অচল পয়সা! 

এরপরে আর বাকি গল্পে বলার কিছু থাকে না। তবে "যুক্তিযুদ্ধ" অনুষ্ঠানে সেদিনের দর্শকরা রোজকার মতো লঘু বিনোদন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়নি। কারণ ঘেঁটে যাওয়া অনুষ্ঠান সামাল দিতে অর্ক-কে যত  বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল, দর্শকরা নিজেদের ততোই লাভবান মনে করছিল! আর কানাঘুষোয় যতদূর জানা গেছে, টেলিভিশন স্টুডিতে ভুবনগিরিবাবুর অভিযোগের প্রতিবাদে ধুন্ধুমার ঝগড়া করে এলেও, পরে কিন্তু আইডিয়াটা কমললোচনবাবুর খুব মনে ধরেছে। আগামী মাসে যখন কেন্দ্রের হেভিওয়েট মন্ত্রী দলীয় প্রচারে রাজ্যে আসবেন, তখন এ ব্যাপারে তাকে প্রস্তাব দেবেন বলে ভেবে রেখেছেন তিনি। দলীয় কর্মীর আটপৌরে বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ অনেকবার হয়ে গেছে। আর খাওয়া মানে তো গ্রহণ করা। সে জায়গায় ত্যাগ শব্দটা জনপ্রতিনিধির জন্য অনেক বেশি লাগসই! সুতরাং উনি যদি  ত্যাগ করতে সম্মত হন, তবে জব্বর জনসংযোগে হবে। অনেককে tag-ও করা যাবে!


ছবিঃলেখক


হোমঠেক    সান্ধ্য জলপাইগুড়ি মূল পাতা

Comments