জনসেবক জগদীন্দ্রদেব রায়কত । ঊমেশ শর্মা


জনসেবক জগদিন্দ্র দেব রায়কত

উমেশ শর্মা

 

বৈকুন্ঠপুরের রায়কত যোগেন্দ্র দেব মানিকগঞ্জের গ্রাম্যবালক জগদিন্দ্রকে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জগদিন্দ্র দেব রাজ গদি পেলে পরিচিত হোন ‘পোষ্য রাজা’ নামে।  তবে কথাটির মধ্যে কোন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল না। সেটা ছিল জলপাইগুড়ির মানুষের সহজ-সরল অভিব্যক্তি মাত্র। অনক্ষর কন্ঠে  সেটা উচ্চারিত হতো 'পশুরাজা'। বলুন তো লোকে কাকে 'শিয়াল দাস' বলে ডাকত?  একদম ঠিক ধরেছেন। সি আর দাসকে।

উনিশশো কুড়ি সালের মে মাসের ২৯ তারিখে বাসন্তী দেবীকে সঙ্গে করে জলপাইগুড়ি এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি অতিথি হয়েছিলেন জগদিন্দ্রদেবের বাড়িতে। তিনি তখন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি। ওই সময়ে শহরে যারা ‘রায়বাহাদুর খানবাহাদুর’ ছিলেন, তাদের পক্ষে দেশবন্ধুকে অতিথি করা সম্ভব ছিল না। জগদিন্দ্র দেব সভা করার অনুমতি দিয়েছিলেন বাড়ির সামনের বিরাট মাঠে।

মাত্র এক বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ। রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেছেন। গান্ধী ত্যাগ করেছেন 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি। জগদিন্দ্রদেব অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট-এর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নেমে পড়েছেন দেশের কাজে। প্রিভি কাউন্সিলে রায়ে ‘রাজার পদ’ বাতিল হয়ে যাবার পর জগদিন্দ্রদেব হয়ে পড়েন একজন ‘প্রজা’ মাত্র। এরপর তিনি রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। ‘রাজা’ থাকাকালীনও  তিনি উদ্যোগ নিয়ে কারারুদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাহায্য করার জন্য ৯৩ টাকা তুলে পাঠিয়েছিলেন।

এক কথায়, ১৮৮৫ সালে রাজত্ব চলে যাওয়াটাই জগদিন্দ্রদেবের জীবনের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ওই বছর কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে জগদিন্দ্রদেব তার সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৯৬ সালে  কংগ্রেসের কলকাতার অধিবেশন ‘নতুন অংশগ্রহণে’র কারণে পরিচিত। জগদিন্দ্রদেব ওই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন তারিণীপ্রসাদ রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ১৮৮৪  সালে জগদিন্দ্রদেবের বিয়ে হয়েছিল সরলতা দেবীর সাথে।  তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের জ্ঞাতিভ্রাতা ষষ্ঠীচরণ সেনের কন্যা।  বিবাহ হিন্দুমতে হয়েছিল এবং বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ  উপস্থিত ছিলেন।

১৮৮৮ সালে রানীর আমন্ত্রণে তিনি বিলেতে যান। ফিরে আসার পরেও তাঁর স্বদেশী মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। গভর্নর একবার চা শিল্পপতি এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে চা পান করেছিলেন। জগদিন্দ্রদেবের কাছেও নেমন্তন্ন গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই চায় পে চর্চায় আগ্রহ দেখান নি। এটা ১৯২২ এর ঘটনা।

জগদিন্দ্রের জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। খদ্দরের কাপড় আর খড়ম পরতেন। চা শিল্পের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল প্রতিকূল। তিনি মনে করতেন, পুঁজির কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত নয়। তিনি পুঁজির গনবণ্টনের পক্ষে ছিলেন। এটা আসলে ছিল তাঁর স্বদেশী মনোভাবের প্রতিফলন। স্বদেশী স্কুল স্থাপন, শরীরচর্চার জন্য অনুশীলন সমিতির উদ্যোগ, আখ আনারস চাষ, ফলের বাগান স্থাপন প্রভৃতি উদ্যোগের পাশাপাশি রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমিতির  প্রচার ও প্রসারে মন দিয়েছিলেন। উক্ত সমিতির অষ্টম সম্মেলনে তিনি ছিলেন সভাপতি। তাঁর ব্যাক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ছিল বেশ সমৃদ্ধ। জেলার প্রথম ইতিহাস লেখার চেষ্টা তাঁর-ই। বইপত্র তিনি ‘আর্যনাট্য সমাজ’কে দান করেন। তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতে যথেষ্ট উৎসাহ ছিল।

জগদিন্দ্রদেব নিজের শৌচালয় নিজেই পরিষ্কার করতেন। এটা ছিল গান্ধীর নির্দেশ। সবাই অনুসরণ না করলেও জগদিন্দ্রদেব প্রাক্তন রাজা হয়েও করতেন। ১৯২৫ সালের ৯ই জুন গান্ধীজী সভা করেছিলেন জলপাইগুড়ি শহরে। সেখানে এখন জে.ওয়াই.এম.এ ময়দান। জগদিন্দ্র সে সভাতে জেলা সভাপতি হিসেবে হাজির হয়েছিলেন ফতুয়া-খদ্দর পরিহিত হয়ে। হাতে ছিল একটা তালপাখা।

১৯৩৯ সালে জলপাইগুড়িতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে উপস্থিত করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস। সম্মেলনস্থল-এর নামকরণ হয়েছিল ‘জগদিন্দ্র নগর’। আগের বছরই জগদিন্দ্রদেব রায়কত নামক এক বর্ণময় চরিত্রের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর প্রতিষ্টিত ‘রায়কত পাড়া’  তাঁর স্মৃতি বহন করছে জলপাইগুড়ি শহরে।


হোমঠেক    সান্ধ্য জলপাইগুড়ি মূল পাতা

 

Comments