জলরং। সৌগত ভট্টাচার্য।
জল রং
সৌগত ভট্টাচার্য
বাবলার হাতের শিরাগুলোকে নদীর মত দেখায়। হাতের পাতার
কাছাকাছি আসলে শিরাগুলো মোহনার মুখে হাজার হাজার ক্লান্ত উপনদী হয়ে যায়, বড় ঢেউয়ের
সাথে মেশার অপেক্ষায়। একটা সময় ছিল যখন পেন্সিল দিয়ে রেখা টানলেই যেন নদীর ঢেউ আছড়ে
পড়ত সাদা কাগজে। সাদা আলোর বাল্ব হাওয়ায় নড়লে পেন্সিল থেমে যায়, শিরায় রক্তের ঢেউও
থামে, বয়েস বেড়েছে। আজকাল খুব বেশি রক্ত স্রোত আর শিরা-উপশিরারা বইতে পারে না। সমুদ্রের
অনেক দূরে ঢেউগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে ফেরত যায় হৃদপিণ্ডের দিকে। না-আঁকাগুলো নিয়ে হৃদপিণ্ডের
মাংস পেশী ছটফট করে। আজকাল আর সাদা কাগজে কোন জলের নোনা দাগ পড়ে না। ঝুলতে থাকা সাদা
বাল্বের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করে রাখে মোটা কাগজ দিয়ে, সরাসরি চোখে যেন আলো না
পড়ে। বাল্বের আলো কিছুটা কাগজের ওপর, বাকিটা কাস্টমারের মুখে দোল খায় নদীর শুকনো হাওয়ার
সাথে। কাস্টমার নড়ে উঠলে বাবলার হাত থেমে যায়, ঢেউও ফিরে যায়। দিনের বেলায় আলোর দরকার
হয় না, রাতের জন্য এই ব্যবস্থা। আলো নিভিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ক্যাম্পে যায় বাবলা। ক্যাম্পে
যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ মেলায় ঘোরে সে। সারারাত মেলা চলে, লোক চলে।
ভুটভুটি করে নদী পেরোনোর সময় হাওয়ায় কাঁচাপাকা চুল
ওড়ে তার। নদীর ওপার দেখা যায় না। বড় বড় ঢেউ এসে লাগে নৌকার গায়ে। ঢেউগুলো শীতল হাওয়া
আনছিল। সোয়েটারের উলের খাঁজে খাঁজে নানা মেলার ধুলো জমে থাকে। পুরানো সোয়েটারে শীত
মানে না। না-দেখা দূরের জল রেখার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে বাবলা ঘাটে পৌঁছানোর। আট
নম্বর লট থেকে সাগর কুড়ি পঁচিশ মিনিটের রাস্তা। দুটো ব্যাগ-- কাঁধের ঝোলা ব্যাগে পেন্সিল
রাবার ড্রইং শিট ছাড়াও কিছু জল রং থাকে, অন্য বড় ব্যাগে আলো ফোল্ডিং টুল কাটবোর্ড।
জল রংগুলো প্রাচীন। সেগুলোকে অনেকেদিন আগেই নদীতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল সে! বহুদিন বহুরাত
জলের স্পর্শ না পেয়ে কুঁচকে যাওয়া চামড়ার মত হয়ে যায় রংগুলো, আলাদা করে রংয়ের উজ্জ্বলতা
বোঝা যায় না। মাঝেমাঝে জল রংগুলোর গায়ে হাত বোলায় বাবলা, ওর হাতের শিরাগুলো ফুলে ওঠে।
ভুটভুটি সাগরে এসে নোঙর করলে হাই ওঠে ওর।
একটা হাতের তালুর সাথে আরেকটা তালু লেগে গেছে লোকটার। দুটো
হাতের তালুতে যেন বটের আঠা। আঙুলগুলোও সেঁটে আছে অন্য হাতের আঙুলের সাথে। কিছুতেই ছড়ানো
যাচ্ছে না একটা হাত থেকে অন্য হাতকে। নিজেই টেনে যাচ্ছে হাত দুটো লোকটা, তাও ছাড়ছে
না। সমানে কেঁদে যাচ্ছে আর গালাগাল করে যাচ্ছে গলা-কানে মাফলার জড়ানো হাতে হাত আটকে
যাওয়া লোকটা। ম্যাজিক করে তার হাতের তালু আটকে দিয়েছে ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিক দেখাতে
মেলায় এসেছে সে। নৌকো থেকে ঘাটে নামা যাত্রীরা সবাই দাঁড়িয়ে লোকটার কান্না দেখছে। ম্যাজিশিয়ান
একটার পর একটা ম্যাজিক দেখিয়ে যাচ্ছে ঘাটের পাশে। ভুটভুটি থেকে নেমে বাবলা ভিড়ের মধ্যে
উঁকি মারে। ম্যাজিশিয়ানের অদ্ভুত এক হাসি মুখ!
একটা বিড়ি ধারায় বাবলা। ঘাট থেকে কুড়ি-বাইশ কিলোমিটার মেলার
দূরত্ব। মেলার সমানে যাওয়ার জন্য একটা ট্রেকারে চেপে বসে। ট্রেকার ছাড়ার কিছুক্ষণ পর
চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায়। বাবলা চোখ খুলে দেখে ম্যাজিশিয়ানের
ঘাড়ে মাথা রেখে হাত বন্ধ হয়ে যাওয়া লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ম্যাজিশিয়ানের মাথা
লোকটার মাথার ওপর, চোখ বন্ধ। ট্রেকার সংক্রান্তির সাগর মেলায় যায়।
কাস্টমারের বসার টুলের পাশে মাছির মত ঘিরে থাকা মুখগুলি চোখ
পিটপিট করে সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেমন
করে লোকে ম্যাজিক দেখে কৌতূহলের চোখে। ম্যাজিকের মতোই সাদা কাগজে ছবি ফুটে ওঠে। বাচ্চাদের
পেন্সিল-স্কেচ পোট্রেইট দুই শ টাকা--- দুই শ টাকার পোট্রেইটে কী কোন মায়া থাকে! সাগরে
আসার আগে কয়েকটা জেলা বইমেলায় কাজ করেছে বাবলা। গত দুই বছর কামাই ধান্দা একপ্রকার বন্ধ
ছিল। হাত বসে যাচ্ছিল। পড়ার ক্লাব ঘরে রোববার করে যে আঁকার স্কুল চলত সেটাও বন্ধ লকডাউনের
পর থেকে, বাচ্চারা আসে না। মেলায় দিনে দুইটা, বড়জোর তিনটা কাজ হয়। বাচ্চাগুলো গাছের
মত নড়ে, বাবলার হাত শিরাগুলো নদীর স্রোতের মত যেন সাগরের সমানে এসে ঢেউ ভেঙে মিলিয়ে
যায়। আবার কখনো নিয়ম মেনে সাদা কাগজের সাগরে গিয়ে পড়ে, জলের মত রেখা তৈরি হয় মাঝেমাঝে।
এতে বাবলার নতুন কাজের কোনো আনন্দ হয় না। কাস্টমার নড়লে আবার নতুন করে মন দিতে হয় কাগজে।
উজ্জ্বল আলোয় বাচ্চাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসলে ঠোঁটের ভাঁজ আঁকে সে। রাতে ক্যাম্পে ফিরে
ব্যবহার না হয়ে শুকিয়ে যাওয়া জল রঙে হাত বোলায় বাবলা।
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে বারবার ছেঁড়া
ঘুম নাকী স্বপ্ন মেশা একটা ঘোরের মধ্যে দেখছিল দুটি হাত জোড়া লেগে যাচ্ছে ওর। কোনো
ভাবেই খোলা যাচ্ছে না। একটি হাত যেন অন্য হাতকে ছাড়তেই চাইছে না। তারপর কাঁধে মাথা
রাখা একটা ঘুম। ঘুমানোর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় ওর। হাতের শিরাগুলো নদী হয়ে যেতে
চায়, স্রোত হয়ে অন্য হাতে ধাক্কা দিতে চায়।
অন্য কোনো হাত বাবলা পায়নি জীবনে, অন্য কোনো শিরা-উপশিরাও না।
পুরুষ মানুষ বাবলাকে দিয়ে ছবি আঁকলেও মহিলারা ছবি আঁকায় না। ব্যাগের ভেতর জল রংগুলো
ক্রমশ শুকিয়ে নদীর মত অন্য দিকে মুখ ঘোরায়। শুকিয়ে যাওয়া রঙের একরকম নিঃসঙ্গ গন্ধ থাকে,
সে গন্ধ পায় বাবলা। কাল সংক্রান্তির মকর স্নান। সকাল থেকে টুল পেতে কাগজ পেন্সিল নিয়ে
মেলায় বসে পড়বে সে।
চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা, পেন্সিলের বিন্দুর মত। আলো ফোটার
আগে থেকেই মানুষ স্নান করছে... সমুদ্র স্নান। সমুদ্রে জল রং মিশিয়ে ছবি আঁকতে ইচ্ছা
হয় ওর। একটি বাচ্চাকে টুলে বসিয়ে বাবলাকে দিয়ে ছবি আঁকাচ্ছিল একজন মা, পাশে দাঁড়িয়ে
থাকা একজন আঁকার দিকে তাকিয়ে কী সব যেন বলতে থাকে। বিরক্ত মুখে আঁকা থামিয়ে সেই লোকটার
দিকে তাকায়। চোখের মণি আঁকার সময় বাচ্চাটি যেন কাউকে খুঁজছিল। এই খোঁজার চোখটা বাবলার
খুব চেনা। আঁকার শেষে অন্য কাস্টমার টুলে বসবে। বাবলাকে এইটুকু সময়ের মধ্যে অন্য একটা
চোখে ঢুকে পড়তে হবে।
ক্লাব ঘরের আঁকার স্কুলে নিয়ে আসা বাচ্চাগুলোর মায়েদের কথা
মনে পড়ে ওর। ভেবেছিল একদিন জল রং দিয়ে বাচ্চার মায়ের ছবি আঁকবে। সেই থেকে জল রং শুকিয়ে
যাওয়া ত্বকের মত কাঠ হয়ে যায়। কোন রং কী রূপ ধারণ করবে সে জানে না। চামড়া রঙের একটা
রং চাই।
বয়সের সাথে সাথে চৌষট্টির দেখার চোখ বদলে নদীর মত হয়ে যায়।
ওর সামনে কোনো মেয়ে ছবি আঁকতে বসেনি কোনোদিন। একসময় কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করত একটা
নারী একটা ষাঁড়। রংটা হয়েছিল নিখুঁত চামড়া রঙের। রক্তের ক্ষিপ্রতার সাথে যে রেখা টানতে
চায় তার সাথে শরীর হাত শিরা সায় দেয় না আজকাল। বয়েস যেন হাত আর রেখাগুলোকে মন্থর করে
দেয়। একবার জলপাইগুড়ি বইমেলায় বিদেশি ছবি আঁকা বইয়ের পাতা উল্টেছিল। অনেক রঙিন পোট্রেইট
ছিল। ছবির তলায় শিল্পীর নাম লেখা ছিল, কাজের তারিখ লেখা ছিল, এই ছবিগুলো কী কোনো মেলায়
আঁকা। কোনো মেলার নাম লেখা ছিল না।
জীবনে আজ একজন মহিলা কাস্টমার টুলে বসেছে বাবলার সমানে। জল
রং দিয়ে পূর্ণ অবয়ব আঁকবে সে। বাবলা আজ নিজের সর্বস্ব দিয়ে আঁকতে চাইছে। বাবলার মত
মেলায় মেলায় পোট্রেইট আঁকিয়ের জীবনে এ সুযোগ বারবার ফিরে আসে না! বারো বছর পর পূর্ণকুম্ভ
স্নানের মত অপেক্ষার শেষ যেন। ব্যাগ থেকে জল রং বের করে শরীরের ত্বকের রং খুঁজতে থাকে
তুলি খুঁজতে থাকে। প্রতিদিন হাতে হাতে ঘোরা সেই রং তুলি খুঁজে পায় না সে তার ছোট্ট
ব্যাগে। বাবলার ভেতরে ভেতরে একটা প্রবল অস্থিরতা কাজ করলেও বাইরে সেটা বুঝতে দেয়না
সে। আজ বাবলাকে নিজের জন্যই আঁকতে হবে একজন নারীকে।
বাবলা আঁকতে শুরু করে চুল কপাল ভ্রু চোখ নাক ঠোঁট গাল গলার
ভাঁজ কাঁধ… তারপর আরো নীচে পেন্সিল নিয়ে যেতে থাকে। মুখের মধ্যে আস্ত শরীর ফুটিয়ে তুলতে
মন চায়। বাবলাকে ঘিরে উৎসুক চোখের ভিড় বাড়তে থাকে। টুলে বসা মহিলা কাস্টমার সরাসরি
বাবলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ভাষাহীন ভাবে। বাবলার হাতের শিরাগুলোর রক্ত ঢেউ যেন
আঙুল বেয়ে সোজা সাদা কাগজের সমুদ্রে ধাক্কা দিতে চায়, নোনা দাগ ফেলতে চায়। হাতের শিরা ফুলে উঠলেও গলার নিচে পেন্সিল নামে না। দমবন্ধ হয়ে আসে বাবলার।
বইমেলায় দেখা বিদেশি পোট্রেইটের বইয়ের ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে, আঁকার স্কুলের বাচ্চাদের
মায়েদের বুকের কথা মনে পড়ে। কিছুতেই সে কাঁধের নিচে নামতে পারে না। নদী যেন মোহনার
মুখে এসে গতি হারায়। হঠাৎ তার অনুভব হয় কেউ তার হাত দুটোকে যেন লাগিয়ে দিয়েছে, হাত
সরছে না। ভিড়ের মধ্যে থেকে সেই একটা হাসির শব্দ ভেসে আসে তার কানে।
ঠিক যে শব্দ সে শুনেছিল গতকাল ভোরে নৌকা ঘটে। চারিদিকে তুমুল মাইকের শব্দ। বাবলার পেন্সিল
আর কাস্টমারের বুক অবধি নামছে না। মহিলা কাস্টমারের চোখ যেন বাবলার অসহায়তা পড়ে ফেলছে।
সংক্রান্তির শীতে সাগরের পাশে বসে সে ঘামতে থাকে। ম্যাজিশিয়ান যেন বাবলার হাত আটকে
দিয়ে হাসতে থাকে হাসতেই থাকে…
ঘোড়ামারা চর সাগর নয়া চর আরো অনেক অনেক দ্বীপ তৈরি হয় ভাগীরথীর
বুকে। মোহনায় নদী খরস্রোতা থাকে না, যৌবন থাকে না। সব গতি শেষে সাগরে মেশার অনন্ত অপেক্ষা
থাকে। জেগে ওঠা দ্বীপগুলোর রং শরীরের চামড়ার মত হয়। শুকিয়ে যাওয়া শিরা সর্বস্ব ত্বকের
মত হয়। পুরোনো জিনিসকে ফিরিয়ে দেওয়ার নাম ম্যাজিক, বাবলা জানে। হাতে হাত লেগে যাওয়া
লোকটি ম্যাজিসিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল। ম্যাজিকের পর ঘুম পড়ে থাকে। মোহনায়
এসে পুরোনো গতি নদী পায় না, জল রং রূপ পায় না। নদী শুধু ক্লান্ত শরীরে মিশতে চায় সাগরে।
ম্যাজিশিয়ান শুধু হাসতে জানে। হাত দুটোকে আটকে দিতে জানে। বাবলার জীবনে কোন ম্যাজিক
হয়নি--- বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল আর খোলেনি, বিদেশি আঁকার বইয়ের মত একটা ছবিও আঁকতে পারেনি।
ম্যাজিসিয়ানের হাসিতে হাত দুটো শুধু অসার হয়ে আসে।
ফিরে আসার সময় বাবলা লঞ্চের জন্য নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। হাজার
হাজার লোক লঞ্চের অপেক্ষা করে। সকলেই মেলা থেকে ফিরছে। বহুদিন ধরে যত্ন করে রাখা জল
রংগুলোর আর কোনো দরকার নেই বাবলা আজ। ওর ঝোলা ব্যাগ থেকে জল রঙের বাক্সটা বের করে।
একটা একটা করে জল রং নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে বাবলা ভাবে নদীর জলের রং পাল্টে
যাবে, সে জল গড়িয়ে নতুন রং লাগবে সাগরের জলে, কিন্তু জলের রং পাল্টায় না। বাবলা দেখে
ফেলে দেওয়া শুকনো জল রংগুলো একটার গায়ে অন্যটা লেগে লেগে পাথর হয়ে যায়। শুকনো চামড়া-রঙের
পাথর।
Comments
Post a Comment